এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন আপাতত রাজনীতির বাইরে। আর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দীর্ঘদিন ধরে দেশের বাইরে। এরমধ্যেও দলে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের চাপা খবর শোনা যায় প্রায়ই। তবে সবশেষ প্রভাবশালী দুই ভাইস চেয়ারম্যানকে শোকজের ইস্যু তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে দলের ভেতরে। ফলে অস্তিরতার খবর অনেকটা প্রকাশ্যে চলে এসেছে।
অভিযোগ আছে, দলের দায়িত্বশীলদের অন্ধকারে রেখে অনেক সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। যা নিয়ে ভেতরে ভেতরে দ্বন্দ্বও হচ্ছে। যদিও বিএনপির হাইকমান্ড বলছে, নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে দল পরিচালিত হচ্ছে। বিএনপিতে কোনো কোন্দল নেই।
গত মার্চে করোনার প্রকোপ শুরুর পর থেকে সেই অর্থে মাঠে বিএনপির কোনো কর্মসূচি নেই। মাঝেমধ্যে মানববন্ধন ও ঘরোয়া অনুষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ দলটির কার্যক্রম। আগে সভা-সমাবেশকে ঘিরে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির তৈরি হলেও এখন তাও নেই। এই অবস্থার মধ্যে গত সেপ্টেম্বরে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়ায় বিএনপির নেতাকর্মীরা।
ঢাকা-৫ ও ১৮ আসনের উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১১ সেপ্টেম্বর নয়াপল্টনে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন। পরে অবশ্য নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। বিষয়টি এখানেই হয়তো শেষ হতে পারত। কিন্তু নয়াপল্টনে হাতাহাতির জেরে পরদিন রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষ হয় গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের সামনে।
বিএনপির মনোনয়ন বোর্ডের সভা চলাকালীন কার্যালয়ের বাইরে ঢাকা-১৮ আসনের প্রার্থী হতে আগ্রহী যুবদল নেতা এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিএনপি নেতা কফিল উদ্দীনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়। এই ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীতে দলের মহাসচিবের বাসায় ডিম ছুড়ে মারার ঘটনাও ঘটে। এ ঘটনায় বহিষ্কারও হন বেশ কয়েকজন।
জানা যায়, উপনির্বাচনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এবং দলের অন্য নেতাদের পছন্দের আলাদা প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এস এম জাহাঙ্গীর মনোনয়ন পাওয়ায় বাকিরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।
অভিযোগ আছে, দলেরই একটি পক্ষ বিক্ষোভকারীদের ইন্ধন যুগিয়েছেন। তাদের কারণেই শেষ পর্যন্ত সংঘর্ষের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটিও আলোর মুখ দেখেনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুবদলের একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ‘নির্বাচন এলেই দেখা যায় সবাই নিজেদের পছন্দের লোককে প্রার্থী করতে চান। শেষ পর্যন্ত দল যাকে বেছে নেয় তার পক্ষে আর এরা কাজ করেন না। ঢাকা-১৮ আসনে সবশেষ এটা স্পষ্ট দেখা গেছে।’
অন্যদিকে দলের কড়া নির্দেশনা থাকলেও ঢাকা-৫ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে সামান্য কাজও করেননি মনোনয়ন বঞ্চিত নবী উল্লাহ নবী। যদিও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত শুরু থেকে শেষ অবধি দলীয় প্রার্থীর পক্ষে মাঠে ছিলেন।
এত গেলো ভোটের মাঠের খবর। সবশেষ গত ১৪ ডিসেম্বর দলের হাইকমান্ডকে না জানিয়ে ঢাকার রাস্তায় বিক্ষোভ করার অভিযোগে শোকজ করা হয় হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও শওকত মাহমুদকে। অভিযোগ উঠেছে, বিক্ষোভের কর্মসূচির মতো তাদের শোকজের বিষয়েও শীর্ষ নেতারা জানতেন না।
শুধু তাই নয়, শোকজের ভাষা নিয়ে রীতিমত প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন সাবেক মন্ত্রী হাফিজ উদ্দিন। রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত শোকজের জবাব দেয়ার পর হাফিজ সাংবাদিকদের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
শোকজের চিঠিতে অনেক ভুল ছিলো দাবি করে তিনি বলেন, দলের ভাইস চেয়ারম্যানকে একজন যুগ্ম মহাসচিব (আদিষ্ট না হয়েও) এমন কঠিন, আক্রমণাত্মক ভাষায় কৈফিয়ত তলব করায় অত্যন্ত অপমানিত বোধ করছি। এখানে প্রটোকল ও সৌজন্যতার ব্যত্যয় ঘটেছে। ’
যদিও রিজভীর দাবি, তার নিজের ক্ষমতাবলে নয় আদিষ্ট হয়ে শোকজের চিঠি দেয়া হয়েছে। রিজভীর স্বাক্ষরে হাফিজ উদ্দিনকে পাঠানো নোটিশো বলা হয়, ‘ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে দলকে বিভক্ত করে মহাসচিব হওয়া, বিভিন্ন সময়ে দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দায়িত্ব দেওয়া হলে সেটা করতে অপরাগতা প্রকাশ করা বিশেষ করে কৃষক দলের মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হলেও তা করতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অসম্মান করে বক্তব্য প্রদান করেছেন।’
তবে এসব অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন হাফিজ উদ্দিন। শোকজের জেরে দল ছাড়ছেন এমন গুঞ্জন থাকলেও এমন সিদ্ধান্ত নেবেন না বলে জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের অনেকে এই দুই ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার দাবি করছেন। তবে দলের স্থায়ী কমিটির সবশেষ বৈঠকে শোকজের বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘শোকজের বিষয়টি বৈঠকের এজেন্ডায় ছিলো না। তাই এটি নিয়ে আলোচনা হয়নি।’ তবে এই দুই নেতার শোকজের জবাবে দল সন্তুষ্ট হয়েছে বলে জানা গেছে। ফলে আপাতত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে না জানিয়েছেন একজন শীর্ষ নেতা।
সার্বিক বিষয় নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন বলেন, ‘সব জায়গায়ই টুকটাক ঝামেলা থাকে। এটা থাকবেই। বিএনপি বড় দল। অনেক বিষয় ঠিকঠাক নাও হতে পারে। তবে যত কথাই বলা হোক বিএনপি সবাইকে নিয়েই চলছে। বড় ধরণের কোনো সমস্যা নেই। যা আছে তা সমাধানযোগ্য। সেদিকে নজর দিতে হবে।’