আজ থেকে শতবর্ষ আগে। এই বাংলায়। পলিধোয়া মাটিতে। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়, মধুমতি নদীর শাখা বাইগারের তীরে, জন্মেছিলেন তিনি। তখনও বাংলার আকাশ ছিল পরাধীন। ব্রিটিশের শাসনকাল। পরাধীন ছিল মানুষের জীবনও। শোষণ, বৈষম্য, নির্যাতন, নিপীড়নের দম বন্ধে আসা মানুষ খুঁজছিল মুক্তির সন্ধান। সেই মুক্তির পয়গাম নিয়ে মধুমতিপারের টুঙ্গিপাড়ায় ভূমিষ্ঠ হয়েছিল এক শিশু। দিনটি ছিল মঙ্গলবার। ১৭ মার্চ ১৯২০। বাংলা বর্ষপুঞ্জির ৩ চৈত্র ১৩২৭।
পরবর্তী সময়ে এই শিশুই বড় হতে হতে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মুক্ত করে পরাধীনতার শেকলে বাঁধা বাংলাকে। জন্ম নেয় বাংলাদেশ। তিনি আমাদের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের বঙ্গবন্ধু। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।
আজও দেশের প্রতিটি ভোরে মিশে আছেন শেখ মুজিবুর রহমান। মিশে আছেন বাঙালির অস্তিত্বে। আজ যে শিশুটির জন্ম হলো, এই স্বাধীন বাংলায় সেও কৃতজ্ঞ বঙ্গবন্ধুর প্রতি। যিনি নিজের জীবন বাজি রেখে এই দেশের মানুষের মুক্তির লড়াই করেছেন। সিংহের মতো গর্জে উঠেছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে তাঁর ঠাঁই। বাঙালির আবেগ, ভালোবাসা, অনুভূতিতে জড়িয়ে আছেন অবিনশ্বর।
টুঙ্গিপাড়ায় বসবাস শুরুর পর শেখ বংশ দিন দিন বড় হতে থাকে। বড় দালানগুলোর আশপাশে আরও বসতি গড়ে ওঠে। এই দালানেরই উত্তর-পূর্ব কোণে টিনের চৌচালা ঘর তোলেন শেখ আবদুল হামিদ। তাঁর ছেলে শেখ লুৎফর রহমান চাচাতো বোন সায়রা বেগমকে বিয়ে করে এই বাড়িতেই সংসার শুরু করেন। তখন চারদিকে ঋতুরাজ বসন্তের আমেজ। সন্ধ্যার পর রাতের নিঝুমতা সবে ছড়িয়ে পড়ছে সবদিকে। এমনই এক ক্ষণে জন্ম নেন ইতিহাসের মহাপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতির জনক।
শেখ মুজিবুর রহমানÍ নামটি রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধুর নানা শেখ আবদুল মজিদ। ‘মুজিব’ শব্দটি আরবি। পবিত্র কোরআনে সুরা হুদের পঞ্চম রুকুর শেষ আয়াতে ‘মুজিব’ শব্দটি আছে। অর্থ ‘উত্তর দেওয়া’। শেখ মুজিব জন্মের পর পর আর সব শিশুর মতো কাঁদেননি। ছিলেন নীরব। তিনি যে ভবিষ্যতে একজন ধৈর্যবান, সহনশীল মহাপুরুষ হবেন, জন্মের শুরুতে সেই আভাসই দিয়েছিলেন। বাবা-মা তাকে আদর করে ‘খোকা’ বলে ডাকতেন। ভাইবোন আর গ্রামের মানুষ ডাকতো ‘মিয়া ভাই’। বঙ্গবন্ধুর নানা তাঁর মেয়েকে বলেছিলেন, ‘মা সায়রা, তোর ছেলের নাম এমন রাখলাম, যে নাম জগৎজোড়া খ্যাত হবে।’ সত্যিই তিনি হয়তো ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীর মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। উৎসব-উদযাপনে প্রস্তুত দেশ। যদিও মহামারি করোনার কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই হবে সব আয়োজন। স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য অতিরিক্ত সচেতন থাকতে হচ্ছে জন্মশর্তবর্ষ উদযাপনের সব সভা-সমাবেশে। বঙ্গবন্ধুর জন্মের শতবর্ষ উদযাপনের সূচনাকাল ছিল গত বছরের ১৭ মার্চ। ঘোষণা করা হয় ‘মুজিব শতবর্ষ’। করোনা মোকাবিলার সুবিধার্তে গত বছর অনেক আয়োজন সীমিত করতে হয়েছিল। যে কারণে মুজিববর্ষের সময়ও এ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত লম্বা করা হয়েছে।
‘মুজিব শতবর্ষে’র পাশাপাশি এবছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীও উদযাপন করবে বাংলাদেশ। এ উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি নানা আয়োজন করা হয়েছে। ১০ দিনব্যাপী জমকালো বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে সরকার। ঢাকায় জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে ১৭ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত এসব অনুষ্ঠান হবে। এর মধ্যে বড় দুটি অনুষ্ঠান হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন অর্থাৎ আজ। অন্যটি স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ।
১০ দিনের বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আজ বুধবার শুরু হচ্ছে ১০ দিনব্যাপী রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির অনুষ্ঠান। আজ বিকালে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত হবে উদ্বোধনী। বিকাল সাড়ে চারটায় জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি সশরীরে উপস্থিত থাকবেন। এসময় শিশুশিল্পীদের কণ্ঠে জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হবে।
আয়োজনে আলোচনা ছাড়াও থাকছে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। আয়োজনকে নিখুঁত করতে গতকাল দিনব্যাপী মঞ্চে চলেছে শেষ মুহূর্তের অনুশীলন। বঙ্গবন্ধুর কর্মজীবন নিয়ে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হবে প্রতিটি পরিবেশনায়।
গান-নাচ, অভিনয়সহ নানাভাবে তুলে ধরা হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কর্মময় জীবন। ১০ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি অতিথিরা উপস্থিত থাকবেন।
চলমান করোনাভাইরাস মহামারির কারণে অতিথি আমন্ত্রণ সীমিত করা হয়েছে। প্রতিদিনের জন্য ৫০০ করে অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আগত সকলকে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করে অনুষ্ঠানস্থলে ঢুকতে হবে।
আগত অতিথিদের বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণা দিতে আয়োজনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হচ্ছে। নানান শৈল্পিকতায় অনুষ্ঠানস্থলে তৈরি করা হয়েছে শহীদ মিনার, পদ্মা সেতু, গ্রামীণ জীবনযাপনের আবহ, জাতীয় মাছ ইলিশসহ নানা দৃষ্টিনন্দন উপস্থাপনা।
মুজিব শতবর্ষের আয়োজনে যা যা থাকছে
বুধবার বিকাল সাড়ে চারটায় জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি সশরীরে উপস্থিত থাকবেন। এসময় শিশুশিল্পীদের কণ্ঠে জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হবে। এরপর পবিত্র গ্রন্থ থেকে পাঠ করা হবে। মুজিব চিরন্তন থিমের ওপর একটি এনিমেশন চিত্র প্রদর্শিত হবে। থিম সংয়ের মিউজিক ভিডিও প্রদর্শিত হবে। স্বাগত ভাষণ রাখবেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানে কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের ভিডিওবার্তা প্রদর্শিত হবে। অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেবেন মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ। পরে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। অতিথিদের কাছে স্মারক হস্তান্তর করা হবে মুজিব চিরন্তনের। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সন্ধ্যা ছয়টার পর বাংলাদেশ এবং ভারতীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত হবে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন ভারতীয় শিল্পী মমতা শংকর ও তার স্বামী চন্দ্রোদয় ঘোষ।