কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশন উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং যথাযথ ভাব-গাম্ভীর্যের সাথে মহান শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০২৩ পালন করেছে।
মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোঃ গোলাম সারওয়ার জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করার মধ্য দিয়ে দিনব্যাপী কর্মসূচি শুরু করেন। এরপর হাইকমিশনার শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় মিশনের কর্মকর্তাবৃন্দ এবং মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে ভাষা শহীদদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অতঃপর, মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং মাননীয় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাণী পাঠ করা হয় এবং ভাষা শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রেক্ষাপটে ‘বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন’ শীর্ষক একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়।
অনুষ্ঠানে হাইকমিশনার তার ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদ, এবং মুক্তিযুদ্ধে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ স্বীকার করা ত্রিশ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ বীরঙ্গনার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন দেশের চূড়ান্ত স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করেছে। তিনি সকলকে বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস জানতে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বাস্তবায়নে আরও কঠোর পরিশ্রম করার আহ্বান জানান।
এবারও, বাংলাদেশ হাইকমিশন ইউনাইটেড চাইনিজ স্কুল কমিটিস এ্যাসোসিয়েশন অব মালয়েশিয়া (ডং জং) এর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছে। অনুষ্ঠানে প্রদত্ত তাঁর ভিডিও বক্তব্যে হাইকমিশনার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষা, সৃজনশীলতা লালন এবং বহুভাষিকতার প্রচারে মাতৃভাষার অবদানের ওপর জোর দেন। তিনি মানুষের মূল পরিচয়-ভাষা এর সাথে সম্পৃক্ত এমন একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করার জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান ।
অপরাহ্নে, বাংলাদেশ হাইকমিশন সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল অফ লিবারেল আর্টস, টেলরস বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া এবং পর্যটন, শিল্প ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, মালয়েশিয়ার সহযোগিতায় “বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য” শীর্ষক একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করে। এই অনুষ্ঠানে মালয়েশিয়া, টেলরস বিশ্ববিদ্যালয় এবং আর্জেন্টিনা, চীন, ভারত, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং নাইজেরিয়া এর দূতাবাস/হাইকমিশন অংশ নিয়েছে।আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানটি তিনটি পর্বে বিভক্ত ছিলঃ উচ্চ-পর্যায়ের আলোচনা, প্যানেল আলোচনা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করা হয় এবং এরপর ২১শে ফেব্রুয়ারির ভাষা শহীদদের স্মরণে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস চিত্রিত একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
উচ্চ-পর্যায়ের আলোচনা পর্বে, বাংলাদেশের মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এম পি তাঁর ভিডিও বার্তায় বলেন, যে কোনো জাতির উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির নিমিত্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’-এর গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি আরও বলেন, ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপনের অনন্য অনুভূতি আমাদের ভাষাগত বৈচিত্র্য রক্ষার তীর্থযাত্রার অনুভূতির সমরূপ।
মালয়েশিয়ায় আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত ম্যানুয়েল বালাগুয়ের সিলাস তার বার্তায় ১৯৫২ সালে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের কথা স্মরণ করে মাতৃভাষা সংরক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি জানান, বাংলাদেশ ও আর্জেন্টিনার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে ঢাকায় আর্জেন্টিনার দূতাবাস পুনরায় খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর্জেন্টিনা। তিনি কাতারে অনুষ্ঠিত বিশ্ব কাপ ফুটবল উপলক্ষে সারা বিশ্বের বাংলাদেশীদের আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের প্রতি স্নেহ ও সমর্থনের অভিব্যক্তি কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরন করেন এবং বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সার্বজনীন ভাষা হিসেবে খেলাধুলার শক্তির কথা তুলে ধরেন।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোঃ গোলাম সারওয়ার তার উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেছেন যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০২৩-উপলক্ষ্যে আয়োজিত এই আন্তঃসীমান্ত বহুভাষিক অনুষ্ঠান দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে ভাষা ও সাংস্কৃতিক সংযোগের সেতু হিসেবে কাজ করবে।
মালয়েশিয়ায় মালদ্বীপের হাইকমিশনার আলী হুসেন দিদি, ব্যাংককের ইউনেস্কো এশিয়া-প্যাসিফিক আঞ্চলিক ব্যুরো ফর এডুকেশনের পরিচালক জনাব শিগেরু অয়াগিও বিশ্বে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠায় ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন। টেলরস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ লিবারেল আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস এর প্রধান ডঃ ওয়ান পুস্পা মেলাতি অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ (সিজিএস) এর পরিচালক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদের পরিচালনায় “বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের প্রচারে ভাষার ভূমিকা” বিষয়ক একটি প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস, বাংলাদেশ এর নির্বাহী পরিচালক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা, মালয়েশিয়ার টেলরস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনাস জুবেদী এবং থাইল্যান্ডের চুলালংকর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুরিচাই উন গাও অংশগ্রহণ করেন।
প্যানেল আলোচনার পরে একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয় যাতে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিগণ নাটক, সংগীত, বাদ্যযন্ত্র এবং নৃত্য পরিবেশনার মাধ্যমে নিজ নিজ দেশের ঐতিহ্য চিত্রায়নের মাধ্যমে বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির অপার সৌন্দর্য তুলে ধরে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানটি বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের প্রানবন্ত উপস্থাপনায় পরিনত হয় এক অনলাইন সাংস্কৃতিক মিলনমেলায়।