পুলিশ ভেরিফিকেশনে দেরি হওয়ায় আটকে পড়েছে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩৮ হাজার শিক্ষক নিয়োগ। ছয় মাস আগে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) নিয়োগের প্রাথমিক সুপারিশ করলেও এখনো ভেরিফিকেশন শেষ হয়নি। এতে চাকরিপ্রার্থীরা চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। অন্যদিকে শিক্ষক সংকটে ক্লাস নিতে হিমশিম খাচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ।
সূত্র জানায়, মামলাসংক্রান্ত জটিলতায় এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই বছর নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ ছিল। গত বছরের শুরুর দিকে সেই জটিলতা কাটিয়ে নিয়োগ কার্যক্রম শুরু হয়। নিয়োগ দিতে গত বছরের ৩০ মার্চ তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে এনটিআরসিএ। এরপর ১৫ জুলাই ৩৮ হাজার ২৬৮ জন প্রার্থীকে প্রাথমিকভাবে সুপারিশ করে এনটিআরসিএ। কিন্তু ছয় মাস হলো পুলিশ ভেরিফিকেশনের অপেক্ষায় রয়েছে এই নিয়োগ।
জানা যায়, ২০২০ সালের শুরুতে সারা দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শূন্যপদের চাহিদা চেয়েছিল এনটিআরসিএ। এতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৫৭ হাজার ৩৬০টি শূন্যপদের তালিকা পাঠায়। আর গত দুই বছরে আরো ৩০ থেকে ৩৫ হাজার শিক্ষকের পদ শূন্য হয়েছে। ফলে এখন প্রায় ৯০ হাজার শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে।
করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেড় বছর বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গত সেপ্টেম্বর থেকে সীমিত পরিসরে স্কুল-কলেজ খোলা হয়। ফলে শিক্ষক সংকটের ব্যাপারটি তেমনভাবে বোঝা যাচ্ছে না। তবে সরকার এ বছর থেকে পুরোদমে স্কুল-কলেজ চালু করতে চায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোপুরি শুরু হওয়ার আগে শিক্ষক নিয়োগ শেষ করা না গেলে বড় ধরনের সংকটে পড়তে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নিয়োগের সুপারিশ পাওয়া প্রার্থীদের দুই ধরনের ভেরিফিকেশন করতে হয়। স্থায়ী ঠিকানায় এবং প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাই করতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভেরিফিকেশন করতে হয়।
তবে রাজশাহীর প্রার্থী নাজমুল হোসেন বলেন, ‘আমার কোনো ধরনের ভেরিফিকেশন এখনো হয়নি। আমরা প্রতিনিয়ত খোঁজ নিচ্ছি। আমাদের ভেরিফিকেশন ফরমই এখনো রাজশাহী পুলিশের কাছে আসেনি বলে জানানো হয়েছে।’
তবে একাধিক চাকরিপ্রার্থী নাম প্রকাশ না করে জানিয়েছেন, তাঁরা যে স্কুল-কলেজে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন, সেখান থেকে তাঁদের প্রতিনিয়ত চাপ দেওয়া হচ্ছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে সুপারিশ পাওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনা বেতনে ক্লাস নিতে শুরু করেছেন।
একটি কলেজে সুপারিশপ্রাপ্ত প্রভাষক শান্ত আহমেদ বলেন, ‘যে কলেজে সুপারিশ পেয়েছি, তারা বারবার যেতে বলেছে। কারণ তাদের শিক্ষক সংকট রয়েছে। ক্লাস নিতে হিমশিম খাচ্ছে। আমার বাড়ি দিনাজপুর। সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি সিলেটের একটি কলেজে। বিনা বেতনে ওখানে চাকরি করলে আমি কিভাবে চলব?’
আসাদুর রহমান নামের আরেক সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষক বলেন, ‘এত দিন নিয়োগ আটকে থাকায় চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছি। আবার চাকরি পেয়েও আমরা বেকার অবস্থায় দিন পার করছি।
আমরা চাই দ্রুত আমাদের নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ করা হোক। যদি ভেরিফিকেশন করতে দেরি হয়, তাহলে শর্ত সাপেক্ষে হলেও আমাদের যোগদানের সুযোগ দেওয়া হোক। প্রয়োজনে যোগদানের পর সেই ভেরিফিকেশন সম্পন্ন করা যেতে পারে।’
জানা যায়, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দুই হাজার ১৫৫ জন শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করেছিল সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। কিন্তু এক বছরেও তাঁদের পুলিশ ভেরিফিকেশনসহ অন্যান্য কার্যক্রম শেষ হয়নি। অবশেষে শর্ত সাপেক্ষে এসব শিক্ষকের পদায়ন দিতে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ। যোগদানের পর তাঁদের পুলিশ ভেরিভিকেশনের কাজ শেষ হবে।
এ ছাড়া কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর গত ১৪ অক্টোবর কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে দুই শতাধিক প্রার্থীকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে। তাঁদেরও যোগদানের পর ভেরিফিকেশনের শর্তে নিয়োগ দেওয়া হয়।
এনটিআরসিএর সদস্য এ বি এম শওকত ইকবাল শাহীন বলেন, ‘তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ৩৮ হাজার ২৬৮ জন প্রার্থীকে প্রাইমারি সিলেকশন করা হয়েছে। এখন ভেরিফিকেশনে পজিটিভ রিপোর্ট এলে আমরা তাঁদের জন্য সুপারিশপত্র পাঠাব। এরপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ তাঁদের নিয়োগ দেবে। ভেরিফিকেশনের রিপোর্ট দ্রুত পাঠানোর জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট বিভাগকে প্রতিনিয়ত তাগাদা দিয়ে যাচ্ছি। তবে কবে নাগাদ এই ভেরিফিকেশন শেষ হতে পারে, সে ব্যাপারে আমাদের এখনো কোনো তারিখ জানানো হয়নি।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক) ফৌজিয়া জাফরীন বলেন, ‘আমরা ভেরিফিকেশনের জন্য ফাইল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। সেখান থেকে ফেরত এলে দ্রুততার সঙ্গে ছাড় করব।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. তরুণ কান্তি শিকদার বলেন, ‘আমরা এসংক্রান্ত ফাইল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কাজ শুরু করেছি। এ ব্যাপারে আমরা এনটিআরসিএর সঙ্গেও বসেছি। দ্রুততার সঙ্গে ফাইল ওয়ার্ক শেষ করে ভেরিফিকেশনের জন্য পাঠানো হয়েছে। তবে ৩৮ হাজারেরও বেশি শিক্ষকের জন্য দুটি সংস্থার ভেরিফিকেশন চলছে। একবারে অনেক বেশি শিক্ষক হওয়ায় কিছুটা সময় লাগছে।’