ইউনেস্কো মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে ‘মেমোরি অফ দা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে’ যুক্ত করেছে। বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হল ভাষণটি বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষণ। পৃথিবীর কোনো ভাষণ কোনো দেশে এতবার প্রতিধ্বনিত হয়নি। ভাষণটি ১২টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়! এই ভাষণটি কালজয়ী যুগোত্তীর্ণ ভাষণ। যুগে যুগে এ ভাষণ নিপীড়ত, লাঞ্ছিত স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রেরণা ও উদ্দীপনার উৎস হিসেবে কাজ করবে। পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চির জাগরুক থাকবে।
বাংলাদেশ মহিলা পুলিশ কর্মকর্তা বিভিন্ন শান্তিরক্ষী মিশনে কাজ করছেন । বর্তমানে বাংলাদেশ মহিলা পুলিশ অফিসাররা দারফুর, মালি, ডিআর কঙ্গো ও দক্ষিণ সুদান সহ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম সুনামের সাথে পরিচালনা করছেন।
জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা অপারেশনের অংশ হিসাবে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারজানা শরীফ বর্তমানে প্রবাসে মালিতে দক্ষতার সাথে কাজ করেছেন। তিনি প্রবাস জীবনে থেকেও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্লেষণ করে নিজের ফেইসবুক পেজে পোস্ট করেছেন, যেখানে ফুটে উঠেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ হৃদয়ের মাঝে কতটা ধারণ করেছেন তিনি।
নিন্মে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারজানা শরীফের ৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্লেষণ তুলে ধরা হল:
২০১৭ সালের ১৮ নভেম্বর আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৭ই মার্চ নিয়ে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনাকে বলেছিলেন, “ইতিহাসের প্রতিশোধ”। কেন বলেছিলেন, কেন বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী “ইতিহাসের প্রতিশোধ”?? সেই ব্যাখ্যাটিই আমি আমার বক্তব্যের মাঝে উপস্থাপন করবো।
৭ই মার্চের ভাষণকে কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছেন “শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প”। আমি বলবো আমার কাছে এটি ‘এক ঐতিহাসিক বিকেলের গল্প’। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বিকেল ২.৪৫ থেকে ৩.০৩…মাত্র ১৮ মিনিটের এ বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু তুলে ধরেছেন আমাদের ১৮ বছরের ইতিহাস! আমি কেন ১৮ বছর বলছি? বঙ্গবন্ধু শুরু করেছেন ১৯৫২ থেকে। তিনি বলেছিলেন, “ দুঃখের সঙ্গে বলছি বাংলাদেশের করুণ ইতিহাস বাংলার মানুষের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খাঁ মার্শাল-ল জারী কর ১০ বছর আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬-দফা আন্দোলনের সময় আমাদের ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ সালের আন্দোলনে আয়ুব খাঁর পতনের পরে ইয়াহিয়া এলেন।” মাত্র ১৮ মিনিটে ইতিহাসকে, আমাদের বাঁচার লড়াই, আমাদের ঐতিহাসিক সংগ্রামকে তুলে ধরা বঙ্গবন্ধুর মত নেতার পক্ষেই সম্ভব। তিনি ৫২থেকে শুরু করে ৭১এর ৭ই মার্চের ঘটনাপ্রবাহকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যেন মনে হয় এ ভাষণটি এক বহমান নদী।
বঙ্গবন্ধু বলেছেন, “আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়।” ৭ই মার্চের এ ভাষণের কারণে নিউজউইক ম্যাগাজিন বঙ্গবন্ধুকে উপাধি দেয় Poet of Politics বা রাজনীতির কবি। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণটি শুরু করেছিলেন এভাবে, “ আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।” সাহিত্যিক বিশ্লেষণে একে বলা যায় dramatic beginning, তিনি শুরুতেই শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে নিতে জানতেন, যা তাঁর জ্ঞাণ-গরিমা, স্থিতধীর প্রকাশ।
বঙ্গবন্ধু বলেছেন, “আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। দেশের মানুষের অধিকার চাই।” এমন নির্মোহ বক্তব্য দেবার জন্য সাহস থাকা চাই। বঙ্গবন্ধুর পর আর কোন নেতার মাঝে আমরা এমনটি দেখিনি।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণে আরও বলেছেন, “মনে রাখুন শত্রুপিছনে ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে।” রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় এখানে গুপ্তচরবৃত্তির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের সাংসারিক জীবনেও এ কথাটি সত্য। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক ঠিকই আছে, কিন্তু তৃতীয় পক্ষ সেখানে কলহ বাধায়। তাই আমাদেরকে সর্বদা united থাকতে হবে।
বঙ্গবন্ধু বলেছেন, “এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান যারা আছে আমাদের ভাই, বাঙালী, অ-বাঙালী তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের উপর।” আমরা এই মিশনে হিন্দু-মুসলিম একই রুমে থাকছি। আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বাস করি হিন্দু- মুসলিম সহাবস্থান করেও অনেক ভাল থাকতে পারে। Unityর এ শিক্ষা আমরা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে পেয়েছি।
আমি বক্তব্যের শুরুতে বলেছিলাম যে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন ‘ইতিহাসের প্রতিশোধ’, কেন বলেছিলেন?
৭ই মার্চের ভাষণ একটা ঐতিহাসিক দলিল, এখনও আমাদের অনেক সংগ্রামের পেছনে এ ভাষণ অনুপ্রেরণা যোগায়। কিন্তু স্বাধীনতার ৪০ বছর পর ২০১১ সালে প্রথম এটি আমাদের সংবিধানে সংযুক্ত হয়, সংবিধানের ৪র্থ তফসিলে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় ১৯৭২ সালে ছিল, “জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।” কিন্তু পরবর্তী সরকারের সময় এসে ‘মুক্তি’ ও ‘সংগ্রাম’ এ শব্দদুটি বদলে দেওয়া হয়। সেটা কি এ জন্য যে বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণটি শেষ করেছিলেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম” এ কথাটি বলে?
“জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম” এর পরিবর্তে বলা হয় “জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধ”। মুক্তি ও স্বাধীনতা এ শব্দ দুটি এক নয়। মুক্তি না বললে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় মুক্তির কথা বলা যায় না, যার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাকিস্তান সরকার আমাদের সাথে প্রতারণা করেছিল। ‘ঐতিহাসিক সংগ্রাম’ এর পরিবর্তে ‘ঐতিহাসিক যুদ্ধ’ বলে সে সকল রাজনৈতিক দল যাদের জন্ম যুদ্ধের পরে। যুদ্ধের আগের ঐতিহাসিক সংগ্রামে যাদের কোন অবদান নেই। এ সংবিধান সংশোধনী আমরা এনেছি ২০১১ সালে।
২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো ৭ই মার্চের ভাষণকে ‘বিশ্ব স্মৃতির আন্তর্জাতিক নিবন্ধন’ করে একে World Documentary Heritage এর মর্যাদা দেয়। এ পরিপ্রক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ইতিহাসের প্রতিশোধ”। কেননা স্বাধীন বাংলাদেশে দীর্ঘদিন এ ভাষণকে নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছিল।১৯৭১,২০১৭… ৭১,১৭… দুইটি সংখ্যার এদিক-ওদিক, অথচ ইতিহাসের মধুরতম প্রতিশোধ!
আজ আমাদের আনন্দের দিন। LDC থেকে উত্তরণে জাতিসংঘের চূড়ান্ত স্বীকৃতি। উন্নয়নের এ পথে বাংলাদেশের পদচারণা অব্যাহত থাকুক, বঙ্গবন্ধুর চেতনা আমাদের সবার মাঝে চির জাগরুক থাকুক অনির্বাণ শিখা হয়ে, এ কামনায় শেষ করছি।
লেখকঃ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারজানা শরীফ,
বামাকো, মালি