দেশে চিনির বিপুল চাহিদার খুব সামান অংশ মেটায় সরকারি মালিকানার চিনিকলগুলো। কিন্তু বছরের পর বছর বেশিরভাগ কারখানা লোকসান দিয়ে চলেছে। সেই লোকসানের বোঝা কমাতে সরকারি ছয়টি কলে চিনি উৎপাদন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত জানানোর পর এসব মিলের শ্রমিক সংগঠনগুলো এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছে। চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, বাজারের চাহিদার মাত্র চার শতাংশ পূরণ করতে পারে সরকারি খাতের চিনিকলগুলো। অথচ এর বিপরীতে কলগুলোতে লোকসানের পরিমাণ কেবল গত অর্থবছরেই ছিল ৯৭০ কোটি টাকা।
লোকসানে জর্জরিত চিনিকলগুলোতে ‘সংস্কার করা হবে’ এমনটা জানিয়ে সরকার সম্প্রতি ছয়টি কলের আখ মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। কার্যক্রম বন্ধ হওয়া চিনিকলগুলো হচ্ছে কুষ্টিয়া, পাবনা, পঞ্চগড়, শ্যামপুর, রংপুর ও সেতাবগঞ্জ চিনিকল। দেশে রাষ্ট্রায়ত্তখাতে সব মিলিয়ে ১৫টি চিনিকলে চিনি উৎপাদন করা হয়।
চিনিকলের চিত্র
শুরুতে ছয়টি চিনিকলে আখ মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ করা হলেও প্রশ্ন উঠছে যে সরকার সব চিনিকলই ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেয়ার পথে এগুচ্ছে কি-না। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই অবশ্য দীর্ঘদিন ধরেই বলছেন যে এসব চিনিকল থেকে কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। তারা এসব কারখানার আধুনিকায়ন ও বেসরকারিকরণের পরামর্শ দিয়ে আসছেন।
তবে চিনিকল বিষয়ক গবেষক মোশাহিদা সুলতানা বিবিসি বাংলাকে বলেন যে চিনিকল হলো এমন একটি শিল্প যেখানে সরকার কোনো প্রণোদনা দেয় না এবং দীর্ঘকাল এগুলোতে কোনো সংস্কার কার্যক্রমও চালানো হয়নি।
তার মতে, দিনে দিনে মিলগুলোকে লোকসানের ফাঁদে ফেলে এখন বন্ধ করার কথা বলা হচ্ছে। আর এটা করা হচ্ছে বেসরকারি খাতের চিনি ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেয়ার জন্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা আরও বলেন, চিনিকল গড়ে ওঠার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। মিলগুলোর সাথে আখচাষিরা জড়িত। ষোল হাজার শ্রমিকের সাথে অন্তত পাঁচ লাখ কৃষক জড়িত। কর্তৃপক্ষ চাইলেই এগুলোর সবকটিকেই লাভজনক করা সম্ভব। এতে দেশীয় এই শিল্পখাত আরও বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে।
আর বাংলাদেশে চিনিকলগুলোর কেন্দ্রীয় শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মাসুদুর রহমান রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকল বন্ধ করার বিপক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন এই বলে যে, এটা করা হলে চরম ক্ষতি হবে অসংখ্য মানুষের।
তিনি বলেন, চিনিকলে তো শুধু চিনি হয় না, আরও অনেক কিছু হয়। এবার জীবাণুনাশক স্যানিটাইজার পর্যন্ত হয়েছে। চাইলে প্রতিটি চিনিকলকে লাভজনক করা যায় কাউকে ছাটাই না করে ও মিল বন্ধ না করেই।
চিনিকল নিয়ে সরকারের ভাবনা
সরকারি খাতের চিনিকলগুলো গত পাঁচ বছরে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। এছাড়া, এসব কারখানার জন্য ব্যাংক ঋণ নেয়া আছে আরও প্রায় আট হাজার কোটি টাকা।এমন পরিস্থিতিতে ছয়টি চিনিকলের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। শ্রমিকদের আশঙ্কা যে চুয়াডাঙ্গার কেরু অ্যান্ড কোম্পানি ছাড়া বাকি সবগুলো কারখানা লোকসানে থাকায় সেগুলোতেও ভবিষ্যতে কার্যক্রম স্থগিত বা বন্ধ করে দেয়া হবে।
চিনি শ্রমিকরা কারখানাগুলোতে পুনরায় কার্যক্রম চালু করতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে এরই মধ্যে আন্দোলনেও নেমেছে।
চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান সনৎ কুমার সাহা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে বর্তমানে চিনির বার্ষিক চাহিদা ১৮ লাখ মেট্রিক টন এবং এর মধ্যে ১৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকল থেকে উৎপাদন হয় ৮০ হাজার মেট্রিক টন।
তিনি বলেন, বাকি ১৭ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টনের চাহিদা মেটায় বেসরকারি উৎপাদনকারীরা র সুগার আমদানি করে তা রিফাইন করে বাজারজাত করার মাধ্যমে। সব মিলিয়ে মার্কেটে আমাদের সত্ত্ব মাত্র চার শতাংশ। কিন্তু কোনো চিনিকল বন্ধ করা হচ্ছে না।
চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান আরও বলেন, সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ছয়টি কারখানায় আখ মাড়াই স্থগিত করা হয়েছে। এর শ্রমিকরা অন্য মিলে বদলী হবেন। আর এসব মিলে যেসব চাষি আখ সরবরাহ করতেন, তাদের আখ অন্য মিল নেবে।
সনৎ কুমার সাহার মতে, চিনিকলে শুধু চিনি উৎপাদন করে টিকে থাকা যাবে না, বরং প্রাসঙ্গিক আরও অনেক কিছু ভাবতে হবে। এখন অনেক মিলের যন্ত্রপাতি পুরনো হয়ে গেছে। এদের জীবনকাল শেষ হয়েছে ৩০ বছর আগেই। এখন আধুনিকায়ন দরকার। সেটিই করা হবে। বিদেশী বিনিয়োগও আসবে, এসব চিনিকলে।
কিন্তু সরকারের এসব যুক্তিতে আশ্বস্ত নন শ্রমিক, চাষিসহ অনেকেই। কুষ্টিয়া, রংপুর ও চুয়াডাঙ্গায় স্থগিত রাখা চিনিকলগুলো পুনরায় চালুর দাবিতে নানা কর্মসূচি পালন করছেন শ্রমিক, কর্মচারী ও চাষীরা।
সংকটের কারণগুলো কী?
চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান করেন যে বড় আকারের এসব চিনিকলে শুধুমাত্র চিনি উৎপাদনে সীমাবদ্ধ থাকাটাই একটা বড় সমস্যা। বাই প্রডাক্ট হিসেবে অনেক কিছু করতে হবে – যেমন ডিস্টিলারি, বায়ো-ফার্টিলাইজার, স্পিরিট, অ্যালকোহল, জীবাণুনাশক, এসব। সব মিলিয়ে এগুলো হলে লাভজনক না হওয়ার কারণ নেই। সেজন্যই সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ যে আখ উৎপাদন হয় তাতে চিনির পরিমাণ কম, আর সে কারণে উচ্চ ফলনশীল জাতের আখ আনতে হবে যাতে অল্প আখে বেশি চিনি পাওয়া যায়। গবেষক মোশাহিদা সুলতানা অবশ্য মনে করেন যে চিনিকলগুলোর বর্তমান যে অবস্থা, তা বছরের পর বছরের দুর্বল ব্যবস্থাপনার ফলাফল মাত্র।
তিনি বলেন, সব খাতকে প্রণোদনা দিলেও আখচাষিদের কখনো প্রণোদনা দেয়া হয় না। সময়মত আখ কেনা, টাকা পরিশোধ করা, বীজ মান বাড়ানো, বীজ দেয়া, পুরো কাজে সমন্বয় না হলে আখের মান ঠিক হয় না। আর এগুলো ঠিক মতো করা হয় না বলেই সিস্টেম লস হয়। পাশাপাশি জমির পরিমাণ ও মিলের সক্ষমতা কমেছে, যেগুলোতে কখনও দৃষ্টি দেয়া হয়নি।
তিনি বলেন, চিনিকলগুলোতে নতুন বিনিয়োগ দরকার এবং প্রযুক্তি উন্নয়ন ও দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। কিন্তু এগুলো না করে ক্রমশ মিলগুলোতে ঋণগ্রস্ত করে ফেলা হয়েছে এবং এটিকেই সংকটের মূল কারণ বলে মনে করেন তিনি।
দেশের শিল্পকে বাঁচাতে কিছু প্রণোদনা দিতে হবে। বিনিয়োগ করতে হবে। লোকসান হয়েছে বলে বিক্রি করবো, এমনটা বললেই হবে না। কারণ এর সাথে লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত”
মোশাহিদা সুলতানার কথায়, দেশের অর্থনীতি এমন কি অর্থনৈতিক সংস্কৃতিতে আখচাষি ও চিনিকলের ঐতিহাসিক ভূমিকা আছে। তিনি বলেন, লোকসানের কারণে বন্ধ না করে বরং সরকারি খাতে আধুনিক চিনিকল ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চিনিখাতে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে।
সরকারি চিনিকল টিকিয়ে রাখা কতটা যৌক্তিক
সরকারি কলগুলো নিয়ে আরও গবেষণা করেছেন অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। চিনিকলগুলোর সক্ষমতা, দায় দেনা, সম্ভাবনা ও বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, সরকারি খাতের ১৫টি চিনিকলের মধ্যে আটটি বন্ধ করে দিলেও এখন যা উৎপাদন হচ্ছে, তা বাকী সাতটি থেকেই পাওয়া সম্ভব।
তিনি বলেন, ১৯৭০-এর দশকে শিল্পায়নের দিকে যাত্রার ক্ষেত্রে এসব চিনিকলের ভূমিকা ছিলো। কিন্তু এখন বেসরকারি খাত অনেক এগিয়ে গেছে এবং তাদের সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার না করা গেলেও তারা বাজারে প্রতিযোগিতামূলক দরে চিনি দিতে পারছে। এসব বিবেচনায় বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিয়ে সরকারিখাতের এই ইন্ডাস্ট্রি ধরে রাখার যৌক্তিকতা নেই।
ড. মোয়াজ্জেম উল্লেখ করেন যে সরকারি চিনিকলে কেজি প্রতি উৎপাদন খরচ ১০০ টাকার বেশি এবং এই দামে বাজারে তাদের চিনি বিক্রি করা অসম্ভব হবে। তাহলে ভর্তুকি দিয়ে চিনিকল রাখতে হবে কেন? তবে সরকার যদি লিকার উৎপাদন করে কলগুলো লাভজনক বা রপ্তানিমুখী করতে পারে সেটি ভালো। কিন্তু না পারলে বিকল্প শিল্পায়নের চিন্তাই করতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের এই গবেষণা পরিচালক মনে করেন যে শ্রমিকদের পাওনা মিটিয়ে চিনিকলগুলোকে কোন ইকনোমিক জোন কর্তৃপক্ষের দ্বারা উন্নতি ঘটিয়ে এবং দায়-দেনা মুক্ত করে দিলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও এগিয়ে আসবে।
তিনি বলেন, বেসরকারি খাতের চিনিকলগুলো বিদেশ থেকে র চিনি এনে তা প্রক্রিয়াজাত করে বাজারে ছাড়ছে, কিন্তু তাদের পূর্ণ ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করা যাচ্ছে না। একদিকে সরকারি চিনিকলের অবদান মাত্র চার শতাংশ, তাও বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিয়ে। অন্যদিকে, বেসরকারি খাত ৯৬ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে কোন ভর্তুকি ছাড়া প্রতিযোগিতামূলক দরে। বেসরকারি খাত যে দামে চিনি দিতে পারে, তা দেয়ার ক্ষমতা সরকারি কলগুলোর নেই।
ড. মোয়াজ্জেম বলেন, সরকারি চিনিকলের যে উৎপাদন খরচ, তার মাধ্যমে বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা অসম্ভব। পনেরটি সরকারি চিনিকলের মধ্যে ১৩টিতে শুধু মাত্র চিনি উৎপাদনের কাজ হয়। অথচ মাত্র সাতটি মিল শতভাগ সক্ষমতায় চললেই সরকারিখাতে এখন যা উৎপাদন হয়, তার সমান পরিমান উৎপাদন সম্ভব। সে কারণে বাকী অন্তত আটটি মিল বন্ধ করে দেয়াই যায়।
তবে বন্ধ করে মিলগুলোকে ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে না দিয়ে যথাযথ একটি কর্তৃপক্ষের কাছে দিয়ে, বিকল্প শিল্পায়ন করে, তাতে আগের শ্রমিকদের প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ দেয়া যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
একমাত্র লাভজনক চিনিকল কেরু, তাও চিনি থেকে নয়। চুয়াডাঙ্গার দর্শনা কেরু চিনিকল সরকারের ১৫টি চিনিকলের মধ্যে একমাত্র লাভজনক এবং গত অর্থবছরে এই লাভের পরিমাণ ছিলো প্রায় ১৪ কোটি টাকা।
এই কারখানায় অবশ্য শুধু চিনি উৎপাদনে লোকসান হয়েছে ৭৫ কোটি টাকা। তবে অন্য খাতের লাভ থেকে সেই লোকসান মিটিয়ে বাড়তি থেকেছে ওই ১৪ কোটি টাকা। এই লাভ এসেছে এই চিনিকলের ডিস্টিলারি এবং বায়ো-ফার্টিলাইজার বিভাগ থেকে। মূলত অ্যালকোহল, ভিনেগার আর হ্যান্ড স্যানিটাইজার থেকে এ লাভ এসেছে বলে জানা যাচ্ছে।
বেসরকারি খাতের চিনিকল
গবেষক মোশাহিদা সুলতানার মতে, বেসরকারি খাতে সম্পূর্ণ কোন চিনি কল নেই। তিনি বলেন, বেসরকারি চিনি আমদানীকারকরা র চিনি এনে রিফাইন করে বাজারজাত করছে এবং বাজারের পুরোটাই এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে। তিনি মনে করেন, চিনিকল বেসরকারি উদ্যোগে হওয়াটা অসম্ভব, কারণ মিল ও চাষির নিবিড় সম্পর্ক একটি সংস্কৃতির বিষয়।
তিনি বলেন, চিনিকলের অনেক সম্পদ, জায়গা-জমি। পাটকলের মতোই সেগুলোর দিকে নজর পড়েছে বলেই বন্ধের কথা বলা হচ্ছে। আধুনিকায়নের নামে কার্যক্রম বন্ধ করা তারই সূচনা মাত্র। সনৎ কুমার সাহা অবশ্য বলছেন যে চিনিকল পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়ার পরিকল্পনা বা ইচ্ছা সরকারের নেই।
যদিও আগাম আখ চাষের জমির পরিমাণ হ্রাস, নিচু জমিতে আখ চাষ, উচ্চ চিনি আহরণযুক্ত ইক্ষুর জাতের অভাব, অপরিপক্ব আখ মাড়াই এবং পুরাতন যন্ত্রপাতির সমস্যা মোকাবেলা করে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো কতদিন টিকতে পারবে – সেটি অনেকের কাছে এখন বড় প্রশ্ন। বিবিসির সৌজন্যে